-জুলফিকার আহমদ কিসমতী
সাধারণভাবে মুসলমানদের মধ্যে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর ব্যাপারে এই আকাক্সক্ষা সকলের মধ্যেই বিদ্যমান যে, কাল কেয়ামতের দিন বিপদের সময় তিনি আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন, আমাদের জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবেন এবং ঐ মহা বিপর্যয়ের মুহূর্তে খুব পিপাসায় ক্লান্ত উম্মতদের তিনি হাউজে কাউসারের সুপেয় শরবত পান করাবেন। কিন্তু পবিত্র কুরআনের সূরা ফোরকানের ৩০-৩২ নম্বর আয়াতে নবী মুহাম্মদ (সা) যে তাঁর উম্মতের একটি শ্রেণীর বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে মামলা-মোকদ্দমাও দায়ের করবেন, সে কথাটির চর্চা খুব কমই হয়ে থাকে। অথচ এটি এমন একটা ভয়ের কথা যেদিকে আমাদের দৃষ্টি অধিক থাকা দরকার। কারণ আল্লাহর যেই মহাগ্রন্থ কুরআন, সেটির প্রতি আমাদের অপরিসীম ভক্তি শ্রদ্ধা থাকলেও তার মর্মবাণী অনুধাবনের চেষ্টা আমরা খুব কম লোকই করে থাকি। কাজেই একথা জেনে নেয়া সকলের জন্য অপরিহার্য, তাঁর কোন্ চরিত্রের উম্মতের বিরুদ্ধে তিনি মামলা দায়ের করবেন। নবী জীবনের অবিস্মরণীয় ঘটনা মিরাজ রাজনীতে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ও তাঁর সাথে কথা বলার মতো সৌভাগ্য অর্জনের মুহূর্তেও যিনি তাঁর উম্মতদের কথা ভুলেননি, আজ সেই দয়ালু নবী কেন ও কোন্ ধরনের উম্মতের বিরুদ্ধে রাগান্বিত হয়ে পরম প্রভুর কাছে অভিযোগ জানাবেন ও মামলা দায়ের করবেন, তা জানা সকলের একান্ত প্রয়োজন। মহানবী (সা) ‘কুরআন পরিত্যাগকারীদের বিরুদ্ধে যেই শব্দে আল্লাহর দরবারে মামলা করবেন, সেই দরখাস্তের শব্দাবলিও আল্লাহ আগে ভাগে সতর্ক হবার জন্যে কুরআন মজিদে উল্লেখ করেছেন, যার উদ্ধৃতি হলো এই :
ইয়া রাববী! ইয়া কওমিত্তাখাযু হাযাল কুরআনা মাহজুরা অর্থাৎ ‘(সেদিন) রাসূলুল্লাহ বলবেন, ‘হে প্রভু! আমার উম্মতের (এ সমস্ত লোক) আল-কুরআনকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছিল’ (সূরা ফুরকান : ৩০-৩২)।
‘কুরআন পরিত্যাগ’ বলতে কি বুঝায় তা কেবল হাদিস এবং নিজের সাধারণ জ্ঞান দিয়ে নয়, খোদ পবিত্র কুরআনের অন্য বক্তব্যের আলোকে কি বুঝায় তাই এখানে উপস্থাপন করছি, যা সকল মুসলমানেরই গভীরভাবে ভেবে দেখা অত্যাবশ্যক।
কুরআন পরিত্যাগের অর্থ হলো :
(১) কুরআন শরীফ বিশুদ্ধভাবে পাঠ না করা। কারণ সূরা মুয্যাম্মিল-এ আল্লাহ এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে, ‘ওয়া রাত্তিলিল কুরআনা তারতিলা’- ‘আর তোমরা ‘তারতীল’ সহকারে শুদ্ধ ভাষায় কুরআন পাঠ করবে (সুরা মুজাম্মিল: আয়াত ৪)।’ ইলমে তাজভীদের পরিভাষায় ‘তারতীল’ শব্দের অর্থ হলো আরবি যেই অক্ষর জিহবার যেখান থেকে উচ্চারণ করার নিয়ম আরবি ধ্বনিতত্ত্ব অনুযায়ী সেই অক্ষর সেখান থেকেই উচ্চারণ করে পড়া। যেমন ‘যাল’ অক্ষরের স্থলে ‘জিম’ অক্ষর না পড়া, ‘আইন’ অক্ষরের স্থলে ‘হামযা’ অক্ষর উচ্চারিত না হওয়া ইত্যাদি।
(২) কুরআনের আয়াতের অর্থ না জানা। পবিত্র কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরাঈল (আ)-এর মাধ্যমে মহানবী (সা)-এর ওপর বিশ্বমানবের কল্যাণে পথনির্দেশক এবং ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, বৈধ-অবৈধের মধ্যে পার্থক্যকারী পরিপূর্ণ বিধানগ্রন্থ। এর অর্থ জানার জন্য এ কারণেই আল্লাহর নির্দেশ হলো : ‘হাত্তা তা’লামূ মাতাকুলুন- নামাজে তুমি যেসব আয়াত পড়ে থাকো, তা যেন বুঝো (সুরা নিসা: ৪৩ নং আয়াত)।’ এ আয়াতটি নাযিলের প্রেক্ষাপট অন্য কিছু হলেও কুরআন যে বুঝে পড়তে হবে সে বিষয়ে কোনো ব্যত্যয় নেই। কেউ ভাষার বিভিন্নতা কিংবা তার কোনো অবৈধ খাদ্যের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট মাদকতার দরুন সাধারণ জ্ঞানশূন্যতা যে কারণেই হোক, কুরআনের অর্থ অনুধাবনে অপারগ হলে সেই বাধা তার দূর করতে হবে। অর্থাৎ যখন তার অর্থ অনুধাবনের অবস্থা বর্তমান থাকবে তখন কুরআন পাঠের সময় অর্থ বুঝার প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। তেমনি অর্থ বুঝতে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা থাকলে হয়তো কেউ বলতে পারেন, আমি অনারবি, কি করে অর্থ বুঝবো? এই বলে অর্থ অনুধাবন থেকে দূরে থাকতে চাইলে, এই অজুহাত গ্রহণযোগ্য না হবারই কথা। কারণ, তখন যদি আল্লাহ তাআলা পাল্টা প্রশ্ন করে বসেন যে, তুমি প্রাইমারি, হাইস্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির নির্ধারিত সকল পাঠ্যবই পড়ার সময় পেলে, বহু সময় ব্যয় করে পত্রপত্রিকার খবর পড়ার সময় পেলে, রাত-দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে জাতীয় ও বিশ্বকাপের বিভিন্ন খেলা দেখার সময় পেলে, আমার কুরআন বুঝার জন্যে তুমি কি পরিমাণ সময় ব্যয় করেছিলে? তখন এ প্রশ্নের জবাব দেয়া কারো পক্ষে বোধ হয় সম্ভব হবে না। আসলে, এটাকে অনন্তকালের সুখ-শান্তির জন্যে জরুরি মনে করা হলে, এটা কোন সমস্যাই নয়। দেশের বড় বড় যোগ্য ইসলামী বিশেষজ্ঞ আলিমগণ স্থানীয় ভাষায় কুরআন মজিদ-এর একাধিক নির্ভরযোগ্য তরজমা রেখে গেছেন, যেগুলো বাজারে অতি সহজেই পাওয়া যায়। অন্তত একটি অনুবাদ সম্বলিত কুরআন শরীফ কিনেও তো নিজেও পরিবারের সকলে আল্লাহর এই নির্দেশের ওপর আমল করা যায়। তারপরও কেউ তা না করলে, কুরআন শুদ্ধ করে না পড়লে যেমন নবীর দায়েরকৃত মামলার আসামি হবে, তেমনি এভাবে অর্থ বোঝার জন্য সময় না দিলেও অভিন্ন কারণে অভিযুক্ত হবারই কথা।
৩. অর্থ বোঝার পর অতঃপর সে অনুযায়ী আমলে সালেহ বা আয়াতের আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী আমল করার প্রশ্ন আসে। কারণ আল্লাহ বারবার পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘‘ইন্নাল্লাযিনা আমানু ওয়া আমেলুস সালেহাত’’- যারা সুষ্ঠু আমল করে, তাদের জন্যই জান্নাত। কেউ আমল করলো কিন্তু সেটা সালেহ বা সুষ্ঠু মানের হলো না, তাহলে আয়াতের অর্থ জানলেও আমল না করার এবং আমল করলেও তা সুষ্ঠু ও লক্ষ্য অর্জনের উপযোগী না হলে সেটাও আমল না করার পর্যায় বলে বিবেচিত হবে। যেমন: একজন রাজমিস্ত্রি একটি পাকা খুঁটি ইট, সিমেন্ট, বালু ইত্যাদি ব্যয় করে নির্মাণ করলো কিন্তু নির্মাণ উপায়-উপকরণাদি যথার্থ মানের না হওয়াতে সেটি এক মাস পর ধাক্কা দেয়ার সাথে সাথে ভেঙে পড়লো। এক্ষেত্রে বুঝা গেল, আমল বা কাজ হয়েছে সত্য কিন্তু তা ‘সালেহ’ সুষ্ঠু বা লক্ষ্য অর্জনের উপযোগী হয়নি। এটা যেমন সেই নামাজির মতো যিনি নামাজের বাহ্যিক সব আমল পালন করেছেন ঠিকই, কিন্তু ‘হুযুরি কলব’ অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় করে, তাকে হাজির নাজির না জেনে নামাজ না পড়ায়, তার নামাজের ‘আমল’ হলেও মূল লক্ষ্য অর্জনের উপযোগী হয়নি। সুতরাং এক্ষেত্রে এটাও কুরআন পরিত্যাগের একটি কাজ করা হলো।
৪. তদরূপ পবিত্র কুরআনে আছে, ‘বাল্লিগ মা উনযিলা ইলাইক’- ‘তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে’, অর্থাৎ কুরআনের আয়াতে তার মাধ্যমে যেসব নিয়ম-নীতি ও শিক্ষা আদর্শ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর তাবলিগ করো, নিজের সন্তান, পরিবার, প্রতিবেশী ও অন্যদেরকেও সব হুকুম-আহকাম পালনে অবাধ্যতাজনিত শাস্তির ব্যাপারে তাদের সতর্ক করো। কেউ যদি ইসলাম প্রচারের এই নির্দেশের ওপর আমল না করলো, ‘আমর বিল মারূফ’- ‘সৎ কাজের হুকুম’ বা দ্বীনের দাওয়াত অপরের কাছে না পৌঁছালো, তাহলে এক্ষেত্রে সে কুরআনের উক্ত হুকুম অমান্য করে কুরআনকে পরিত্যাগ করলো। সুতরাং কুরআন পরিত্যক্ত অবস্থায় রাখার অপরাধে সে অভিযুক্ত হলো।
৫. এভাবে পবিত্র কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ নির্দেশ করেছেন, তিনি আল্লাহর রাসূলকে পাঠিয়েছেন দ্বীন তথা ইসলামী জীবনব্যবস্থা ও বিধি-বিধানসমূহকে ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনে মানবরচিত অন্যান্য বিধি ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী তথা এগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। যেমন সূরা সাফে ইরশাদ হচ্ছে : ‘‘হুয়াল্লাযি আনযালা রাসূলাহু বিল্হুদা, ওয়া দ্বীনিল হাক্কি, লেইউযহিরাহু আলাদ্দীনে কুল্লিহী ওলাও কারিহাল মুশরিকুন।’’ অর্থাৎ আল্লাহ সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে বিভিন্ন পথনির্দেশক বিধি-বিধান ও আইন-কানুন দিয়ে এ জন্য পাঠিয়েছেন, যেন তিনি আল্লাহর জীবন বিধানকে (মানবরচিত) বিধি-বিধান ও মতাদর্শের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও তাকে মুশরিক (আল্লাহর অবাধ্যরা) অস্বস্তিবোধ করবে, জ্বলে পুড়ে মরবে (সুরা আশ-শফ: ৯ নং আয়াত)।
সুতরাং কেউ উপরোক্ত চারটি কাজ সম্পাদন করলেও যদি ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনে আল্লাহর দীনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার পঞ্চম কাজটি না করলো, ‘ইযহারে দীন’ ও ‘ইকামতে দীনে’র প্রচেষ্টা ও আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতার দায়িত্ব পালন না করে নির্লিপ্ত ভূমিকা অবলম্বন করলো, তিনিও এ পর্যায়ের কুরআনি নির্দেশ অমান্য করে কুরআনকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন।
উল্লিখিত পাঁচটি কারণই কুরআনের আয়াতনির্ভর। কাজেই এগুলো অস্বীকারের কোন উপায় নেই। বলাবাহুল্য, মহানবী (সা) ও তাঁর সঙ্গীদের একটি আদর্শ জাতি ও সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তাঁদের জীবনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কুরআনের এই শিক্ষারই প্রোজ্ব¡ল দৃষ্টান্ত ভেসে ওঠে। অতএব, প্রতিটি ঈমানদার মুসলমানকে কেয়ামতের দিন মহানবী (সা) কর্তৃক আল্লাহর দরবারে আনীত মোকাদ্দমায় অভিযুক্ত আসামিদের তালিকা থেকে রক্ষা পেতে হলে তাদের প্রতি পবিত্র কুরআনের দাবি অবশ্যই পূরণ করতে হবে আর এ জন্য অধিক পরিমাণে কুরআন চর্চার প্রতি সকলকে মনোযোগী হতে হবে : ১. তাজভিদুল কুরআন ২. ফাহ্মুল কুরআন ৩. আমল বিল কুরআন ৪. তাবলিগুল কুরআন ও ৫. ইযহারুল কুরআনের এই ৫টি দাবি যথাযথভাবে সকলের পূরণ করা একান্ত জরুরি। অন্যথায় পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত এই আয়াতের ভিত্তিতে তার ব্যতিক্রমকারীদের বিপদের আশঙ্কা আছে বৈ কি!